পরিবেশ দূষণ
ভূমিকা :
পরিবেশ মানবজীবনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক নিয়মে ভারসাম্য বজায় রেখে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের আশ্রয় দেয় , তাদের ভার বহন করে পরিবেশ। কিন্তু গত কয়েক দশকে সেই পরিবেশই আধুনিক সভ্যতার নানা প্রয়ােজন মিটাতে গিয়ে ভয়ানকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে পরিবেশের প্রভাব তার ওপর পড়তে শুরু করে। পরিবেশ যদি শিশুর সুস্থ সবলভাবে বেঁচে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় , তবে উন্নত জাতি গড়ে উঠবে না। সুস্থ পরিবেশই শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনকে ফুলের মতাে বিকশিত করে তুলতে পারে।
পরিবেশ দূষণ কী :
পরিবেশ হলাে জীবজগতের চারপাশের আকাশ - বাতাস , জল - মাটি , আলাে - তাপ এবং অন্যান্য জড় ও , সজীব বস্তু। যে পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে মানুষের তথা জীবজগতের বিকাশ সম্ভব হয় তা - ই হলাে তার পরিবেশ। দূষিত পানি , অতিরিক্ত শব্দ , দূষিত বাতাস , ধুলােঝড় , দাবাগ্নি , জনবিস্ফোরণ , বৃক্ষনিধন ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবন বিকাশ যখন বাধাগ্রস্ত হয় , সেটাই পরিবেশ দূষণ। জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৫ জুনকে ঘােষণা করেছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ
দূষণের কারণ :
পরিবেশ দূষণের নানা কারণ রয়েছে। প্রাকৃতিক ও মানুষের কারণে পরিবেশ দূষণ ঘটে। অপরিকল্পিত নগরায়ন , শিল্পায়ন , জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি , বৃক্ষনিধন ও বনভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার বিশেষভাবে পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবেশ দূষণে মানবসৃষ্ট কারণগুলাের মধ্যে বিজ্ঞান আশ্রিত যন্ত্রসভ্যতা , দ্রুতহারে বংশবৃদ্ধি , বসতি স্থাপনের জন্যে অরণ্য নিধন , কলকারখানার ধোঁয়া , আণবিক - পারমাণবিক প্রতিযােগিতা , ব্যাপক হারে কীটনাশকের ব্যবহার , বায়ুদূষণ , পানিদূষণ , শব্দদূষণ , মাটিদূষণ ইত্যাদি প্রধান। এ সবকিছুই পৃথিবীর পরিবেশকে নষ্ট করছে।
বায়ুদূষণ :
যন্ত্রযুগে কলকারখানার চিমনির ধোঁয়া এবং নানা গ্যাস বাতাসকে দূষিত করছে। তারকাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় বাতাস দূষিত হচ্ছে। কয়েক বছর আগে ভারতের ভুপালের ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানির গ্যাস লিকজনিত দুর্ঘটনায় বাতাস দূষিত হয়ে ৩,৪০০ জন নর - নারী মারা গিয়েছিল। প্রতিদিনের পােড়ানাে কয়লা ও জ্বালানি থেকে যে মারাত্মক গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মেশে তার পরিমাণ প্রায় ৮০,০০০ কিলােগ্রাম। প্রত্যহ চলমান যান্ত্রিক যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাসের পরিমাণ ১,৭২,৬০৮ কিলােগ্রাম। আমাদের দেশেও বায়ুদূষণের এ জাতীয় কারণ কম নয়।
পানিদূষণ :
কলকারখানার বর্জ্য আবর্জনা ও রাসায়নিক পদার্থ মেশানাে পানি সমুদ্র , নদনদী , জলাধার প্রভৃতিতে পতিত হয়ে পানিকে দূষিত করে। শহরের যাবতীয় ময়লা পানি ড্রেনের ভেতর দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। এছাড়া বর্ষার প্রথম দিকে মাটির ওপরে থাকা দূষণকারী কঠিন পদার্থ পানিতে মিশে যায়। ফলে সেই এলাকার পানিতে দূষণ বাড়ে।
শব্দদূষণ :
আজকাল শব্দদূষণ অনেক বেড়ে গেছে। শহরে শান্তিতে বসবাস করা মুশকিল। কারণ হাজার রকমের শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয়। কলকারখানার ধাতব শব্দ , যানবাহনের শব্দ , মাইকের আওয়াজ , উৎসবের সময় আতশবাজির আওয়াজ মারাত্মক শব্দদূষণ ঘটায়। সেসব আওয়াজ ৯০-১২০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। এছাড়া কলিং বেলের শব্দ , ফেরিওয়ালার হাঁকডাক , মােবাইল ফোনের উচ্চ রিংটোন শব্দদূষণ ঘটায়।
মাটিদূষণ :
বিজ্ঞানের যুগে জমি থেকে অধিক ও একাধিকবার খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে মাটি হারাচ্ছে নিজস্ব ক্ষমতা। ক্ষতিকারক কীটনাশকগুলাে রয়ে যাচ্ছে মাটিতে। এতে উৎপন্ন শস্যাদি আমাদের রােগ প্রতিরােধের ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাছাড়া এসব রাসায়নিক উপাদান নদী ও জলাশয়ের পানিতে মিশে গিয়ে জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবন নাশের কারণ হচ্ছে।
বন ধ্বংস :
জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে বাংলাদেশে মুক্তাঞ্চল ও বনভূমির পরিমাণ কমছে। প্রতি বছর উজাড় হচ্ছে বনের বিরাট অংশ। ফলে ভূমিক্ষয়ের মাত্রা বাড়ছে , বন্যা প্রতিরােধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং দেশের গড় তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের প্রতিকার :
পরিবেশ দূষণ একটি বিরাট সমস্যা। বিশ্ববাসী পরিবেশ সচেতন না হলে ধ্বংস অনিবার্য। আমাদের দেশেও পরিবেশ দূষণ জটিল রূপ ধারণ করেছে। এর প্রতিকারের জন্যে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। যেমন :
১. পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
২. দেশের মােট আয়তনের ন্যূনতম ৫০ % এলাকায় বনায়ন করতে হবে।
৩. বর্তমান জ্বালানি পরিবর্তন করে বাতাস , সৌর ও পানি বিদ্যুতের মতাে পুনব্যবহারযােগ্য জ্বালানির প্রচলন করতে হবে।
৪. বন উজাড়করণ ও ভূমিক্ষয় রােধ করতে হবে।
৫. শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য পরিশােধনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে।
৬. বর্জ্য থেকে সংগৃহীত গ্যাস জ্বালানি হিসেবে এবং পরিত্যক্ত পদার্থটি সার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
৭. কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৮. কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে।
৯. পরিবেশ দূষণ প্রতিরােধের কাজকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে।
১০ , শিল্পকারখানাগুলাে আবাসিক এলাকা থেকে দূরে স্থাপন করতে হবে।
১১. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রােধ করতে হবে এবং শিক্ষার হার বাড়াতে হবে।
১২. পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বাঁধের পাশে বনায়ন করতে হবে।
উপসংহার :
পরিবেশ দূষণ যেভাবে বিশ্বকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে , তাতে বিশ্বের বিজ্ঞানী ও চিন্তানায়কগণ গভীর উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারও সচেতন হয়ে উঠেছে। তবে পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব কেবল সরকারের একার নয় , এ দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির। যারা অজ্ঞতাবশত পরিবেশ দূষণে যুক্ত হচ্ছেন তাদের সচেতন হওয়া প্রয়ােজন। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়ােজনেই পরিবেশ দূষণ রােধে সকলকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।