আমার প্রিয় উপন্যাস
ভূমিকা :
প্রকৃতিপ্রেমিক কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির নিরাভরণ সৌন্দর্যের ভাষ্যকার। তিনি কর্মসূত্রে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানুষের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাকে শিল্পীর নিপুণ তুলিকায় অঙ্কন করেছেন তার উপন্যাসগুলোতে। ‘ আরণ্যক ’ বিভূতিভূষণের অমর সৃষ্টি।
' আরণ্যক ’ উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য :
‘ আরণ্যক ’ উপন্যাস বিভূতিভূষণের একটি অমর সৃষ্টি। এই উপন্যাসটির পরিকল্পনা সাধারণ উপন্যাস থেকে আলাদা৷ প্রকৃতি এখানে মুখ্য , মানুষ গৌণ। সীমাহীন অরণ্য - প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য লেখকের কল্পনাপ্রবণ দৃষ্টিকে উন্মোচিত করেছে এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জীবনের অমৃতরস আহরণ করে বেড়িয়েছেন। উপন্যাসটিতে সমগ্র অরণ্য প্রকৃতি লেখকের মন ও কল্পনাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
অরণ্য প্রকৃতির রহস্যময়তা :
বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি সেরেস্তার কর্মচারী সত্যচরণ ওরফে ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণের মনে যে বিচিত্র অনুভূতি ও দার্শনিক চেতনার উদ্রেক করে এক অনবদ্য কল্পনালোকের সৃষ্টি করেছিল , তার আশ্চর্য সুন্দর বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘ আরণ্যক ’ উপন্যাসে। অরণ্য - প্রকৃতি এখানে মূক বধির রূপে নেই , সে যেন মানুষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রূপে তার অন্তরে কখনো রহস্যময় অসীমতা , দুরধিগম্য বিরাটত্বের চেতনা সৃষ্টি করেছে , আবার কখনো ভয় - জাগানো অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। সব মিলিয়ে বিভূতিভূষণ এক রহস্যভরা প্রকৃতির আত্মমগ্নতার অবচেতন রূপটি উদ্ঘাটন করেছেন।
অভিজ্ঞতার মুক্তাবিন্দু :
নির্জন লবটুলিয়ার দিগন্তব্যাপী দীর্ঘ ঝাউ ও কাশের বনে নিস্তব্ধ অপরাহ্ণে প্রকৃতির এক বিশেষ রূপ লেখকের মনকে যেন অসীম রহস্যানুভূতিতে ও স্বপ্ন কল্পনায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। লবটুলিয়া থেকে পূর্ণিয়া যাবার সময় দীর্ঘপথ জুড়ে লেখক রহস্যঘেরা অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের অনুভূতি লাভ করেছেন — সেই অনুভূতি জীবনের অভিজ্ঞতার মুক্তাবিন্দু স্বরূপ। আকাশ সেদিন ছিল কৃষ্ণা - তৃতীয়ার চাঁদ , জ্যোৎস্নালোকে চতুর্দিক উদ্ভাসিত — উঁচু - নিচু পাহাড়ি পথ ঝাউ ও কাশের বনে ভরা। নির্জন , নীরব , মনুষ্য বসতিহীন সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে যেতে যেতে লেখকের মনে এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি জেগে ওঠে। আবার পূর্ণিয়া থেকে ফেরার পথে রনের মধ্যে পথ হারিয়ে জ্যোৎস্না - রাত পাহাড়ি এলাকার অরণ্য প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য লেখকের মনকে অপার্থিব ভাব - চেতনায় আচ্ছন্ন করে।
প্রকৃতির প্রশান্ত রূপ :
সুবিশাল অরণ্য প্রকৃতির মানুষ আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও তার শক্তিশালী প্রাণব্যঞ্জনার কাছে মানুষের ছোট - খাটো সুখ - দুঃখ , আশা - আকাঙ্ক্ষা , ব্যথা - বেদনার আবেগ - দীপ্তি কত অকিঞ্চিৎকর। প্রকৃতির সঙ্গে তাকে মিলিয়ে চলতে হয় , প্রকৃতির এককোণে সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে থেকে প্রকৃতির দিকে দু - চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে হয়। এখানে মানুষের মনের উদ্দাম চাঞ্চল্য , কামনার লালসা , হতাশার বেদনা কিংবা অহমিকার আকাশস্পর্শী পক্ষবিস্তার নেই , তার পরিবর্তে আছে সমাহিত মনে সৌন্দর্য সৃষ্টির অনুভূতি। প্রকৃতিই যেন এখানে মানুষের একান্ত আপনজন , মানুষের নিত্যসহচর এবং তার নিয়ন্তাশক্তি।
অরণ্যের ভয়াল রূপ :
অরণ্য প্রকৃতির মধ্যে যেমন আছে শান্ত - শ্যামল সৌন্দর্য , তেমনি আছে এক বিস্ময় - ভয় জাগানো প্রকৃতির রূঢ় - নির্মম ভয়াল রূপ। জঙ্গলেও শুকনো পাতা ও লম্বা লম্বা ঘাস সূর্যের তাপে শুকনো হয়ে বারুদের মতো পড়ে আছে। আর একমুহূর্তে জ্বলে উঠেছে সমগ্র অরণ্য - প্রকৃতি। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টির ফলে সমগ্র বনভূমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল , দাবাগ্নি শিখায় চতুর্দিক ছারখার হয়ে পুড়ে গেছে। সেই আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য জঙ্গল ভেঙে ছিঁড়ে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ছুটে চলেছে কত বন্যপ্রাণী , শেয়াল , খরগোশ ও বুনো শূকরের দল। এছাড়া নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সেখানকার জলহীন ধূসর অরণ্যপথে কাকর মাটিতে চলতে চলতে পথ হারিয়ে বুকফাটা তৃষ্ণা নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় কোনো কোনো পথহারা পথিক। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে তার ক্ষোভ নেই- তবু একটিবার একটুখানি জল পেতে চায় সে।
অতীন্দ্রিয় রহস্যানুভূতি :
অরণ্য - প্রকৃতির আর এক রূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে যেখানে জ্যোৎস্না পুলকিত নিশীথে কখনো কখনো পাহাড়ি ঝরনার ধারে আসে অশরীরী জিন - পরিরা , কখনো বা তারা মানুষের কল্যাণের জন্য হাত তুলে পথ দেখায় , কখনো বা নানা অমঙ্গলের ছায়া শিহরণ জাগায়। কার সাধ্য যে এদের মুখোমুখি হতে পারে। বিভূতিভূষণ নিপুণ স্রষ্টার মতো সূক্ষ্ম তুলিকার সাহায্যে সেই অনুভূতির চিত্রগুলোকে ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ করে প্রকাশিত করেছেন তাঁর অমর শিল্পসৃষ্টি ‘ আরণ্যক ’ উপন্যাসে।
বিচিত্র মানুষের সমাবেশ :
' আরণ্যক ' উপন্যাসের অরণ্যসভায় প্রকৃতির যেমন বিচিত্র রূপের সমাবেশ , তেমনি আছে বিচিত্র মানুষের ভিড়। কবি যুগল প্রসাদ , সাঁওতালরাজ দোবরুপান্না , তাঁর নাতনি তরুণী ভানুমতী , নৃত্যবিশারদ ধাতুরিয়া , নির্জন স্বপ্নসাধক রাজু পাড়ে প্রভৃতি বহুবিচিত্র প্রকৃতির মানুষের ভিড় জমে। সেই সঙ্গে ভিড় জমিয়েছে জয়পাল কুমার কুন্তারাজ পুতানী , গণোরী তেওয়ারী , গিরিধারীলাল প্রমুখ। প্রবাসী দরিদ্র বাঙালি পরিবারের কয়েকজন ডাক্তার রাখাল বাবুর বিধবা স্ত্রী , যুবতী কন্যা ধ্রুবা , জবা প্রমুখ দীর্ঘ - প্রোথিত বাঙালি সমাজের সংস্কার বিস্তৃত হয়ে অরণ্য সমাজের শ্রম - কর্কশ ও অনভিজাত জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে গেছে।
উপসংহার :
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির নিরবচ্ছিন্ন রূপকে জীবনের দর্পণে প্রতিফলিত করে দেখেছেন বলে স্বভাবতই মাঝে মাঝে দার্শনিক কল্পনার অনুগামী হয়েছেন। শিল্পী বিভূতিভূষণ পৃথিবীর বিরাট ও বিশাল স্বরূপ সম্মন্ধে সচেতন বলেই কল্পনার নেশায় জীবনের চিরন্তন যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে অরণ্যানির শ্যামলিমার তরঙ্গ - ভঙ্গের দিকে তাকিয়ে মনে করতে বসেন— “আমি যেন একা এ অকূল সমুদ্রের নাবিক- কোনো রহস্যময় স্বপ্ন বন্দরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়াছি”। ‘ আরণ্যক ’ উপন্যাসের রহস্যময়তার অনবদ্যতা এখানেই।