পাঠাগারের প্রয়ােজনীয়তা
সূচনা :
মানুষের অন্তবিহীন যাত্রার সমাপ্তি ঘটলেও তার চিন্তাভাবনা , ধ্যান - ধারণা অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা থাকে। আর এই বন্ধন রচিত হয় বইয়ের মাধ্যমে। মানুষ তার মেধা ও মননকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত করে বইয়ের মাধ্যমে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে , বইয়ের সংগ্রহশালা হিসেবে লাইব্রেরির গুরুত্বও তাই অপরিসীম।
পাঠাগার কী :
পাঠাগার শব্দটা শুনলে চোখের সামনে ঘরভর্তি সারি সারি বইয়ের দৃশ্য ভেসে ওঠে। কেননা পাঠাগার হলাে বইয়ের সংগ্রহশালা যেখানে নানা বিষয়ের বইয়ের সমাহার থাকে। ব্যক্তি তার রুচি অনুযায়ী যেখান থেকে বেছে নিয়ে বই পড়তে পারে। এটা মানুষের চিন্তাভাবনাকে অতীত , বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযােগ ঘটায় । মানুষ জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করার সুযােগ পায় পাঠাগারের মাধ্যমে।
পাঠাগারের ইতিহাস :
পাঠাগারের ইতিহাসে যেসব ব্যক্তির বিশেষ উল্লেখ রয়েছে তাঁদের অনেকেই বড়াে শাসক বা প্রশাসক ছিলেন। পূর্বে বিভিন্ন দলিল - দস্তাবেজ মাটির ফলকে লিখে রাখা হতাে। মিশর , গ্রিস এবং ভারতে পূর্ব থেকেই পাঠাগার ছিল বলে প্রমাণ রয়েছে। খ্রিষ্টের জন্মের তিনশ বছর আগে গ্রিসে বেশ কিছু পাঠাগার ছিল। প্রাচীন যুগের অপর এক বৃহৎ লাইব্রেরি ছিল পারগামাসে। খ্রিষ্টপূর্বে তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত হয় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। লাইব্রেরি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রথম ধারণা পাওয়া যায় রােমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। মুসলিম বিশ্বে কর্দোভা , দামেস্ক ও বাগদাদে ও বেশকিছু পাঠাগার ছিল। বাদশাহ হারুন - অর রশিদের পাঠাগারেরও বেশ নাম ছিল বলে জানা যায়।
পাঠাগারের বিকাশ :
বর্তমান পৃথিবীতে অনেক সমৃদ্ধ পাঠাগার রয়েছে। আধুনিক যুগের বিখ্যাত গ্রন্থাগারগুলাের মধ্যে ব্রিটেনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম , ফ্রান্সের বিবলিওথিক ন্যাশনাল লাইব্রেরি , মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি , আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস , কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের প্রথম কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকায় ১৯৫৩ সালে। এটি সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার বা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার নামে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি লাইব্রেরি এই কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সহযােগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। ' আলােকিত মানুষ চাই ' শ্লোগানে ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির প্রচলন করেছে। এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কিছু আধুনিক ও স্বচ্ছ মানসিকতার মানুষের সহায়তায় পাঠাগার গড়ে উঠেছে। এমন একজন মহৎ মানুষ হচ্ছেন পলান সরকার। মানুষের দ্বারে দ্বারে তিনি জ্ঞানের আলাে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।
পাঠাগারের শ্রেণিবিভাগ :
পাঠাগারের বিভিন্ন রকমের ভাগ রয়েছে। যেমন— সাধারণ , পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত। সাধারণ পাঠাগার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পাঠাগারে ব্যক্তির পছন্দ অপছন্দ গুরুত্ব পায়। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছামতাে গ্রন্থের দেখাই বেশি মেলে। এছাড়াও যেসব পাঠাগার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্থাপন করা হয়ে থাকে সেগুলােকে জাতীয় পাঠাগার বলে।
পাঠাগারের প্রয়ােজনীয়তা :
মানুষ তার মনের খােরাক জোগানাের জন্য পাঠাগারে যায়। মানুষের একঘেয়ে জীবনে প্রাণের স্পন্দন এনে দেয় পাঠাগার। একটা ভালাে বই একজন ভালাে মানুষ গড়তে বিশেষ অবদান রাখে। তাই প্রমথ চৌধুরী গ্রন্থাগারকে বলেছেন মনের হাসপাতাল ’ বইয়ের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভে সমর্থ হয়। উন্নত , শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যে পাঠাগারের ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়া ভালাে বন্ধু হিসেবে বইয়ের তুলনা নেই। কোন মানুষকে নৈতিক অধঃপতন হতে টেনে তুলতে পারে একমাত্র বই। যে জাতির সমৃদ্ধ পাঠাগার নেই , সে জাতির সমৃদ্ধ ইতিহাসও নেই। তাই সমাজের উন্নয়নের স্বার্থে পাঠাগারের ব্যাপক প্রসার অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার :
জ্ঞানই মানুষকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে আলােয় উদ্ভাসিত করে। তাই অজ্ঞানতার অভিশাপ হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য পাঠাগারের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। গ্রামে শিক্ষার আলাে পৌঁছানাের ক্ষেত্রে পাঠাগার অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তাই গ্রামে এবং পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার গড়ে তােলা আবশ্যক। এতে দেশ ও জাতি প্রগতিশীলতার পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হবে।