অধ্যবসায়
সূচনা :
সাফল্য লাভের জন্য প্রয়ােজন সাধনার। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ভুল থেকেই মানুষের জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতা। সুতরাং সমস্ত ভুলকে শুধরিয়ে সাফল্য লাভের জন্য বার বার চেষ্টা বা সংগ্রাম করার নামই অধ্যবসায়। অন্তহীন সংগ্রামের ইতিহাসই জীবনের ইতিহাস। জীবনের বিকাশের মূলে রয়েছে যে অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ , তা সেই সংগ্রামেরই কাহিনি। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে আজ অন্যতম মানবিক গুণ হচ্ছে অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ের বলেই মানুষ পৃথিবী থেকে অসম্ভব কথাটি বিতাড়িত করেছে।
অধ্যবসায়ের প্রয়ােজনীয়তা :
অধ্যবসায় মানবজীবনের সংগ্রামের মৌল প্রেরণা। সংগ্রামে জয় আছে , পরাজয় আছে। কিন্তু পরাজয়ই শেষ কথা নয় , পরাজয় হচ্ছে জয়েরই পথিকৃৎ। অতএব ধৈর্য ধরাে , ধৈর্য ধরাে , বাধাে বাধাে বুক। বার বার চেষ্টার ফলেই মানুষের ভাগ্যাকাশে সাফল্যের ধ্রুবতারা ওঠে। জীবনের ব্যর্থতাই সাফল্যের সােপান। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড়াে হয় , অসাধ্য সাধন করতে পারে। জগতে বড়াে বড়াে শিল্পী , সাহিত্যিক , বৈজ্ঞানিক , সেনানায়ক , ধর্মপ্রবর্তক সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ী তাই মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে অধ্যবসায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ছাত্রজীবনেও সফলতা অর্জনে অধ্যবসায়ের মূল্য অপরিসীম। গভীর আত্মপ্রত্যয় সহকারে অবিরাম অনুশীলন করলে দুরূহ বিষয়ও আয়ত্তে এসে যায়। এ রকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবিচল অধ্যবসায় মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌছে দেয়।
মানবজীবনে অধ্যবসায় :
মানবসভ্যতার সেই জন্মলগ্ন থেকে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল , আজও তার শেষ হয়নি। এ সংগ্রামই মানুষের অভিজ্ঞানপত্র। জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে প্রয়ােজন সাহস ও অধ্যবসায়। এ শক্তিই মানুষের মহৎ চারিত্রিক লক্ষণ। দুর্বলচিত্ত মানুষ কখনাে অধ্যবসায়ী হতে পারে না। কারণে - অকারণে সামান্য প্রতিকূল আঘাতেই তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। যারা দৃঢ়চিত্ত , অধ্যবসায় তাদেরই চরিত্রের মহৎ মানবিক গুণ। শান্ত চিত্তে প্রতিকূলতাকে জয় করার মূলে আছে অধ্যবসায়। অন্য সকল মানবিক সদগুণের মতােই জীবনে অধ্যবসায়েরও সযত্নে লালন , পরিচর্যা প্রয়ােজন। নিরন্তর অনুশীলনেই এ বৃত্তির বিকাশ ঘটে।
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় :
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়ােজন সর্বাধিক। ছাত্ররা সমাজের ভবিষ্যৎ গৌরব কেতন। বিশ্বের কোটি কোটি বঞ্চিত ভাগ্যহত মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অধ্যবসায়ী ছাত্র অল্প মেধাশক্তিসম্পন্ন হলেও সাফল্য লাভ করতে পারে। কাজেই অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীকে হতাশ না হয়ে পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহে অধ্যয়নে মনােনিবেশ করা উচিত। কারণ অধ্যবসায়ই পারে ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিয়ে সাফল্যের গৌরবে অভিশিক্ত করতে।
দৃষ্টান্ত :
ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী ব্যক্তিই মানবজন্মকে সার্থক করে তােলেন। অনেক বাধা - বিপত্তির মধ্য দিয়েই মনীষীরা কর্মের পথে এগিয়ে গেছেন অবিচল নিষ্ঠায়। তাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কত কালবৈশাখীর ঝড়। তারা জীবনে পেয়েছেন কত লাঞ্ছনা। সবলের রক্তচক্ষু শাসনেও তারা অকুতােভয় , নির্ভীক থেকেছেন। ত্যাগ , ধৈর্যে তারা মানুষের কাছে তুলে দিয়েছেন অমৃতের পাত্র। সেইসব মহামানবের পুণ্য - স্পর্শে সাধারণ মানুষের জীবন ধন্য হয়েছে। রাজার দুলাল গৌতম বুদ্ধও একদিন জীবনের সত্য সন্ধান করতে গিয়ে সুখের স্বর্ণ - সিংহাসন থেকে নেমেছেন পথের ধুলােয়। প্রতিকূলতাকে তিনি জয় করেছিলেন অসীম ত্যাগ আর তিতিক্ষায়। অধ্যবসায়ই ছিল তার সেদিনের মন্ত্র। মহানবি হযরত মুহম্মদ (স.) এর জীবনেও দুঃখ - কষ্টের আঘাত কম ছিল না। সহনশীলতা মানুষের জীবনকে যে কী পরিমাণে সত্যের আলােকে উদ্ভাসিত করতে পারে , তাদের জীবনই এর প্রমাণ। এ ছাড়া সাহিত্য - শিল্প - বিজ্ঞান সাধনায়ও মানুষের অধ্যবসায়ের তুলনা নেই। ম্যাক্সিম গাের্কি , দস্তয়েভস্কি জীবনে কি কম দুঃখ পেয়েছিলেন ? রবীন্দ্রনাথও কি কম নিন্দা - সমালােচনার বাণে জর্জরিত হয়েছিলেন ? চরম দারিদ্র্য হতাশার মধ্যেও কত কবি - সাহিত্যিক সুন্দরের আরাধনা করে গেছেন। এমনই অনেক বিজ্ঞানীকেও বার বার অধ্যবসায়ের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজদের সাথে পরপর ছয়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে শত্রুর হাত থেকে স্বদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
উপসংহার :
অধ্যবসায়ই মানুষকে পৃথিবীতে স্মরণীয় - বরণীয় করে রাখতে পারে। তাই আমাদের অধ্যবসায়ী হতে হবে। যারা সংকল্পে অটল , জীবন যাদের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ তাদের কাছে অসাধ্য কিছুই নেই। একমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ নিজের জীবনকে সুষমামণ্ডিত করে দেশ ও জাতির কাছে স্মরণীয় - বরণীয় হতে পারে।