মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য
ভূমিকা :
মাতাপিতার কাছে সন্তানের ঋণের শেষ নেই। জন্মের জন্যে আমরা পিতামাতার কাছে ঋণী। বিশেষ করে জন্মের পর থেকে সন্তানের জন্যে মা যা করেন সে ঋণ কোনােদিন পরিশােধ করা সম্ভব নয়। এজন্যে প্রত্যেক ধর্মেই মাতাপিতাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায় মনে করে , মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। আবার বলা হয়েছে , “ পিতা ধর্ম , পিতা কর্ম , পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি। মাতাপিতা তাদের দুঃখ - কষ্টের কথা ভুলে যেমন পরম স্নেহ - মমতা দিয়ে ছােট থেকে বড় করেছেন , তেমনি তাদের প্রতিও আমাদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
মাতাপিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক :
মাতাপিতার কারণে দুনিয়ার আলাে - বাতাসে আগমনের সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। মা অতি কষ্টে দশ মাস দশ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। নিজের দেহের রক্তবিন্দু দিয়ে তাকে বড় করে তােলেন। মাতৃগর্ভই সন্তানের প্রথম আশ্রয়ঘল। মায়ের গর্ভ থেকে দুনিয়াতে আসার পরও মাকে ছাড়া তার একমুহূর্ত চলে না। মাতৃস্তন্য পান করেই সন্তান বাচে এবং তিল তিল করে বড় হয়। একটু বড় হয়ে উঠলেই মাতাপিতা সন্তানের খের কথা ভাবতে শুরু করেন। ব্যস্ত হয়ে পড়েন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সন্তান যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা নিয়ে পিতামাতার চেষ্টার অন্ত থাকে না। এজন্যে তাদের কঠোর শ্রমে অর্জিত অর্থ ব্যয় করেন। তাতে তাদের কোনাে অসুবিধা হলেও সন্তানকে তা জানতে না দিয়ে হাসিমুখে সহ্য করে নেন। সন্তানের সুখের জন্যে কোনাে কষ্টই তাদের কাছে কষ্ট মনে হয় না। কাজেই সন্তান তার জন্ম , ছােট থেকে বড় হওয়া , বেঁচে থাকা , শিক্ষা - দীক্ষা , সবকিছুর জন্যে মাতাপিতার কাছে আজীবন ঋণী। এভাবেই মাতাপিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য রূপে গড়ে ওঠে।
মাতাপিতার অবদান :
মাতাপিতার স্নেহ - মমতার পরিমাণ সীমাহীন। একে দৈর্ঘ্য বা ওজন দরে মাপা যায় না। সকল মাতাপিতাই সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে পরম স্নেহে সন্তানকে বড় করে তােলেন। তার লালন - পালন করা , পড়াশােনা , সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি নিয়ে মাতাপিতা সারাজীবনই উদ্বিগ্ন থাকেন। সন্তানের প্রতি তাদের ভালােবাসার পিছনে কোনাে স্বার্থচিন্তা নেই। তারা কখনােই কোনাে বিনিময় আশা করেন না। মাতাপিতা নিজে অনাহারে থেকে সন্তানকে খাওয়ান , নিজে না পরে ভালাে পােশাকটি সন্তানের গায়ে তুলে দেন। সন্তান অসুস্থ হলে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। যে পর্যন্ত সন্তান সুস্থ হয়ে না ওঠে সে পর্যন্ত তাদের আহার নিদ্রা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। দিনরাত অসুস্থ সন্তানের শয্যার পাশে বসে উৎকণ্ঠায় সময় কাটান। সন্তানের রােগমুক্তি ও কল্যাণের জন্যে দরকার হলে যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করতেও দ্বিধাবােধ করেন না। কঠোর পরিশ্রম ও সীমাহীন দুঃখ - কষ্ট সহ্য করে মাতাপিতা যা আয় রােজগার করেন , তা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানের জন্যেই ব্যয় করেন। সন্তানের জন্যে তারা বিশাল বটবৃক্ষের মতাে। এই বটবৃক্ষের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এবং শান্তির ছায়াতলে সন্তান বড় হয় , বিকশিত হয়। সন্তানের সুখই তাদের সুখ। সন্তানের মুখে হাসি ফুটলেই তাদের মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। সন্তানের জীবনে মাতাপিতা তাই আশীর্বাদস্বরূপ। অবাধ্য ও বিপথগামী সন্তানের জন্যেও মাতাপিতার সহানুভূতি ও ভালােবাসা কোনাে অংশেই কম থাকে না। সন্তান প্রতিবন্ধী হলে স্নেহ - ভালােবাসার অনুভূতি যেন আরাে বেড়ে যায়। তাই মাতাপিতাকে অবহেলা করা সন্তানের জন্যে গর্হিত কাজ।
সন্তানের কর্তব্য :
দুনিয়াতে সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য। সন্তানের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। তাদের যথার্থ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা। সন্তানের শ্রদ্ধা ও বিনয় - নম্র আচরণে তারা সবচেয়ে বেশি খুশি হন , মনে রাখতে হবে , মাতাপিতার শাসনের আড়ালে থাকে নির্মল ভালােবাসা , মঙ্গল কামনা। মাতাপিতা যেমনই হােক না কেন , সন্তানের কাছে তারা সবসময় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাই কখনােই তাদের অবাধ্য হওয়া উচিত নয়। অবাধ্য সন্তান মাতাপিতার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের সাফল্যে মাতাপিতার আনন্দ হয় অর্থাৎ কৃতী সন্তান তাদের কাছে মাথার মুকুটস্বরূপ। যে সন্তান মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অনুগত , তারা জীবনে সফল হয় , সুনাম অর্জন করে। অনেক মাতাপিতা আছেন যারা নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দান করেন। সেই সন্তান উচ্চশিক্ষিত হয়ে বড় পদে চাকরি নিয়ে অনেক সময় মাতাপিতার কথা ভুলে যায় , কোনাে দায়িত্ব পালন করে না , তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাতাে দূরের কথা
সাধারণ কর্তব্যও পালন করে না , এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে ? মানুষ বৃদ্ধ হলে শিশুর মতাে অসহায় হয়ে পড়ে। এ সময়ে মাতাপিতা সন্তানের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অনেক কিছুই নিজের শক্তিতে করতে পারেন না। তখন তাদের খোঁজ - খবর না নিলে , তাদের আদর - যত্ন না করলে তারা আরাে অসহায়বােধ করেন এবং মনে মনে কষ্ট পান। তাই এ অস্থায় তাদের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি বেশি নজর রাখতে হবে। মাতাপিতার সেবা - শুশ্রুষার প্রতি সবসময় যত্নশীল হওয়া সন্তানের একান্ত কর্তব্য।
কর্তব্য পালনের দৃষ্টান্ত :
মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও কর্তব্য পালনের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। হয়রত আব্দুল কাদির জিলানি (রা.) ডাকাত কর্তৃক আক্রান্ত হয়েও মিথ্যা কথা না বলে মায়ের আদেশ পালন করেছেন। তিনি ডাকাতকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তার সঙ্গে থাকা টাকার কথা। এতে ডাকাত সর্দার অভিভূত হয়ে অসৎপথ ত্যাগ করে সৎপথে ফিরে এসেছিল। হযরত বায়েজিদ বােস্তামি (রা.) অসুস্থ মাতার শিয়রে সারারাত পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাড়িয়েছিলেন , যাতে ঘুম থেকে জাগার সাথে সাথে পানি দিয়ে মায়ের সেবা করতে পারেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের ডাকে দুর্যোগপূর্ণ রাতে দামােদর নদী সাঁতরে ছুটে গিয়েছিলেন। তারা সবাই জীবনে সফল হয়েছেন এবং মহান ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
উপসংহার :
সন্তানের প্রধান কর্তব্য হলাে মাতাপিতার খোঁজ - খবর রাখা। বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনে তাদের সেবা এবং তাদের প্রতি যথার্থ কর্তব্য পালন করে সন্তান হিসেবে অন্তত নিজের জন্মঋণ শােধের চেষ্টা করা। অবশ্য মাতাপিতার ঋণ কখনাে শােধ করা যায় না। এ ঋণ অপরিশােধ্য। তাদের সেবার মধ্য দিয়ে জীবনকে গৌরবান্বিত করা যায়।